অধিকাংশ ব্যাক্তির নামের শুরুতে বা শেসে পারিবারিক উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক শব্দ যুক্ত থাকে যা বংশ পদবি নামে পরিচিত। বিসিএস, ব্যাংকসহ প্রায় সকল ভাইভাতে বংশ পদবি নিয়ে কম বেশি প্রশ্ন করা হয়। তাই ভাইভার পূর্বে নিজের বংশ পদবি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে ভাইভা বোর্ডে যাওয়া উচিত। এ বিষয়টিকে বিবেচনা রেখে এখানে কতিপয় বংশ পদবির ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করা হলো। নিজের বংশ পদবির তথ্য জেনে এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিন।
শেখ বা শাইখ
ইসলামের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ উপাধিগুলোর অন্যতম হলো শেখ বা শায়েখ। শেখ শব্দটি আরবি শায়খ শব্দ থেকে এসেছে। ইসলামের প্রথম দুই খলিফাকে একসাথে শায়খাইন বা দুই শায়খ বলা হয়ে থাকে। বিশুদ্ধ হাদিসের প্রধান দুইটি গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিম শরিফের দুই লেখককে একসাথে বলা হয় শায়খাইন। এছাড়া যুগে যুগে যেসব হাদিসবেত্তা হাদিস চর্চায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের শায়খ বলা হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা) সরাসরি যাঁকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন, তিনি বা তাঁর বংশধরও শেখ পদবি লাভ করেছেন। তাছাড়া নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের সাথে সাথে যাঁরা এই নতুন ধর্মকে গ্রহণ করেন, নও মুসলমান হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তাঁরাও শেখ পদবি ধারণ করেছিলেন।
সৈয়দ
নবী নন্দিনী হজরত ফাতেমা ও হজরত আলীর বংশধর থেকে এসেছে সৈয়দ পদবি। সৈয়দ বংশীয় নারীদের উপাধি হয়ে থাকে সৈয়দা বা শরীফা। ইসলামের প্রাথমিক যুগে হাসান ও হোসাইন উভয়ের বংশতালিকায় নবীর বংশধর বুঝাতে সৈয়দ এবং শরীফ উপাধিদ্বয় ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে হাসানি বংশ বুঝাতে পুরুষদের শরীফ ও নারীদের শরীফা এবং হোসাইনি বংশীয় বুঝাতে পুরুষদের সৈয়দ এবং নারীদের সৈয়দা উপাধিতে ভূষিত করার রেওয়াজ লক্ষ্য করা যায়।
চৌধুরী
চৌধুরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ চরের মালিক। চৌধুরী শব্দটি সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ চতুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। সামন্ত রাজার উপাধি ছিল চৌধুরী। সে সময় তালুকদাররা সংগৃহিত করের ১০% নিজস্ব প্রয়োজনে বরাদ্দ করতে পারলেও কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত তালুকদার এক চতুর্থাংশ রাখার অধিকার পেতেন। চতুর্থাংশ শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে চৌধুরী। বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসারে চতুর (মসনদ) এর সাথে ধর (ধারক) যুক্ত হয়ে চৌধরী > চৌধুরী হয়েছে।
ভূঁইয়া
ভূঁইয়া শব্দটি সংস্কৃত ভূমি শব্দ থেকে এসেছে। ভূঁইয়া পদবি দিয়ে ভূমির মালিকানা বুঝায়। সামন্ত রাজার সময় যে সব মানুষ বনজঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি ও চাষাবাদের শুরু করেছে, তাঁরা রাজার কাছ থেকে ভূঁইয়া নামে অভিহিত হয়ে ঐসব জমির স্বত্ব লাভ করেছে। বাঙালি হিন্দু সমাজের ভৌমিক শব্দের পরিবর্তে বাঙালি মুসলমানগণ ভূঁইয়া পদবি ব্যবহার করে থাকেন।
মজুমদার
মজুমদার ফারসি শব্দ। মৌজা শব্দের সাথে ফারসি দার শব্দ যোগ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে মজুমদার। যার অর্থ মৌজার অধিকর্তা। মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে যাঁরা এক বা একাধিক মৌজার অধিকর্তা ছিলেন, তাঁদের মজুমদার বলা হতো। অর্থাৎ মৌজার ভূস্বামীরা মজুমদার হিসেবে অভিহিত হতেন।
তালুকদার
আরবি তালুক এবং ফারসি দার শব্দ যোগে গঠিত হয়েছে তালুকদার। তালুকদার শব্দের অর্থ তালুকের কর্তা। সুলতানী আমল, মোগল আমল এবং ব্রিটিশ আমলে জমিদারের অধীন ২২০০ বিঘা জমিকে বলা হতো এক তালুক। সে সময় যাঁরা জমিদারের নিকট থেকে ন্যূনতম এক ভালুক জমি বা ভূসম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন তাঁরাই তালুকদার বলে অভিহিত হতেন। এভাবে তালুকদারগণ হয়ে উঠতেন উপজমিদার।
তরফদার
আরবি তরফ এবং ফারসি দার মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। তরফদার শব্দের অর্থ হলো তরফের কর্তা। সুলতানী আমল, মোগল আমল এবং ব্রিটিশ আমলে জমিদারের অধীন পরগনার অংশ বিশেষ ভূখন্ডকে বলা হতো তরফ। আর তরফের তৃস্বামীকে বলা হতো তরফদার।
শিকদার
সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল (এলাকা) নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি ভাষায় শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। শিকের সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। শিকদাররা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী শান্তিরক্ষী রাজকর্মচারী। শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে তাঁরা শিকদার উপাধি পেয়েছিলেন।
মীর
অনেকে মীর শব্দটিকে ফার্সি শব্দ পীর এর আরবি পরিভাষা হিসেবে অনুমান করেন। আবার অনেকেই মনে করেন, মীর বা মির শব্দটি আরবি শব্দ আমীর থেকে এসেছে। মীর অর্থ দলপতি, নেতা ইত্যাদি। মুঘল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন সামরিক শাখার প্রধানদের মীর পদবি দেওয়া হতো। ব্রিটিশ সরকারও তাঁদের অনুগত মুসলমান জমিদার ও নবাবদের রাজকীয় পদবি হিসেবে মীর পদবি দিয়েছেন।
মিঞা
মিঞা বা মিয়া শব্দটি ফারসি শব্দ থেকে এসেছে। প্রধান ব্যক্তি বুঝাতে মিয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া উচ্চপদস্থ মুসলিম সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্যও মিঞা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সেই অর্থে সকল মুসলমানের পদবিই হচ্ছে মিত্ররা। বাঙালি হিন্দু সমাজের মহাশয় শব্দের পরিবর্তে বাঙালি মুসলমানগণ মিয়া পদবি ব্যবহার করে থাকে।
আখন্দ
খন্দকার ও আখন্দ বা আকন্দ বা আকন সমার্থক শব্দ। আখন্দ বা আকন্দ বা আকন নামে যে সব পদবি ব্যবহৃত হয় সেটাও খন্দকার পদবিরই একটি রূপভেদ। পরিবর্তনটা খন্দকার > আখন্দ / আকন্দ > আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ বা আকন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক।
সরকার
সরকার শব্দটি ফারসি থেকে আগত। শব্দটির অর্থ প্রভু, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা ইত্যাদি। মোঘল আমলে এ দেশের যে সব স্থানীয় শিক্ষিত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গকে রাজার প্রধান কর্মচারি এবং সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে করা হয়েছিল তাঁদের সরকার বলা হতো।
মোল্লা
মোল্লা আরবি শব্দ মাওলা এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মাওলা অর্থ রক্ষক, কর্তা, অভিভাবক ইত্যাদি। বঙ্গীয় শব্দকোষে মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। প্রকৃতপক্ষে মোল্লা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট পন্ডিত ব্যক্তি। কালের পরিক্রমায় মসজিদে নামাজ পরিচালনাকারী ব্যক্তি মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। অনেকেই পন্ডিত না হওয়া সত্ত্বেও মোল্লা পদবি ধারণ করে বলেই লোকে বলে, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।
খন্দকার
সাধারণভাবে খন্দকার শব্দের অর্থ হচ্ছে কৃষক বা চাষাবাদকারী। অনেকে মনে করেন, ফারসি কনদহ (কৃষি) এর সাথে কার যুক্ত হয়ে কনদহকার > খনদহকার > খন্দকার হয়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, খন্দকার শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত কন্দ (ফসল) এর সাথে কার যুক্ত হয়ে কন্দকার > খন্দকার হয়েছে। তবে ফারসি ভাষার খান্দান (পড়া) ও কার্দান (কারী) শব্দ মিলে খন্দকার শব্দের উৎপত্তি হয়। যার অর্থ হলো শিক্ষক। খন্দকার পদবিটি বাংলাদেশ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মন্ডল
মন্ডল শব্দের অর্থ প্রধান। অতীতকাল থেকে কোনো গোষ্ঠীর প্রধানকে মন্ডল বলা হতো। খাজনা আদায়কারী ও রায়তের মধ্যে মধ্যস্ততা কিংবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন। তাদের অধীনে পাটোয়ারি, তহসিলদার, চৌকিদার ইত্যাদি কর্মচারী কাজ করতেন।
ফকির
ফকির আরবি ফকর শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ নিঃস্ব, দরিদ্র ইত্যাদি। মুসলমানদের মধ্যে সন্ন্যাসবৃত্তি থেকেই এসেছে ফকির পদবি। মরমী সাধক এবং দরবেশ ব্যক্তিগণ সাধারণত এ দেশে ফকির নামে পরিচিত। বিশেষ কোনো ধর্ম মতের একান্ত অনুসারী না হয়ে যাঁরা সকল ধর্মের মূলনীতি নিয়ে আত্মতত্ত্বের সন্ধান করেন তাঁরাও ফকির নামে পরিচিত।
শাহ
শাহ ফারসি শব্দ। আধুনিক ফারসি ভাষায় শাহ অর্থ বাদশাহ বা রাজা। ভারতবর্ষের সুলতানী আমলের শাসকেরা এবং মোগল শাসকেরা নিজেদের নামের সাথে শাহ পদবি ব্যবহার করতেন।
ঠাকুর
বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতে, ঠাকুর শব্দটি সংস্কৃত ঠাকুর > ঠকুর > ঠাকুর থেকে এসেছে ইংরেজি ভাষায় ঠাকুরকে সাধারণত Tagore বানানে লেখা লেখা হয়। পদবিগত দিক থেকে ঠাকুর ব্রাহ্মণের পদবি বিশেষ, এমনকি এই ক্ষত্রিয়েরও উপাধি। পাচক ব্রাহ্মণও একপ্রকার ঠাকুর বলে পরিচিত। অতীতে কোনো বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবাররের (যেমন- কুশারী, ভট্টাচার্য, লোকদের সম্মান করে ঠাকুরমশাই বলে ডাকা হতো। পর্যায়ক্রমে সেটা ঠাকুরে রূপ নিয়েছে। যেমন- জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আগের পদবি ছিল কুশারী।
দাস / দাশ
বাঙালি হিন্দু সমাজে দাস বা দাশ বংশ পদবির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। গবেষকরা মনে করেন, যে সমস্ত হিন্দু সম্পদায়ের মানুষ পদবিতে দাশ লিখেন, তাঁরা ধীবর (জেলে) সম্প্রদায় থেকে এসেছেন। আর যাঁরা দাস লিখেন, তাঁরা ভৃত্য শ্রেণি থেকে এসেছেন।
রায়
রাজন শব্দ থেকে রায় শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। রাজন অর্থ রাজা। রায় শব্দটি রাজন / রাজা > রায়া > রায় এভাবে এসেছে। নবাবী আমলে যিনি সহস্র সৈন্যের অধিপতি হতেন, তাকে রায় উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হতো।
মল্লিক
মল্লিক শব্দটি আরবি মালিক বা মলিক শব্দ থেকে এসেছে। লিপিকুশল রাজকর্মচারিকে মোগল আমলে মল্লিক বা সুলেখক আখ্যা দেওয়া হতো।
বিশ্বাস
রাজারা আত্মরক্ষার্থে অথবা রাজবংশ কিংবা রাজভান্ডারের গোপন সংবাদ কোনো বিশ্বস্ত লোকের কাছে গচ্ছিত রাখতেন। কারণ গুপ্ত হত্যায় বা অন্য কোনো কারণে হটাৎ রাজার মৃত্যু ঘটলে যাতে সেই বিশ্বস্ত লোক পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকারীদের কাছে সে খবর পৌঁছে দিতে পারেন। সেই বিশ্বস্ততা থেকেই এসেছে বিশ্বাস পদবি।
দেওয়ান
দেওয়ান ফারসি শব্দ। ফারসি ভাষায় শব্দটির মূল অর্থ হলো গ্রন্থ বা কাগজের বাঁধন। চাকলার অর্থসচিবদের এবং খাজনা আদায়কারীদের দেওয়ান বলা হতো। সেখান থেকেই দেওয়ান পদবি এসেছে।
বড়ুয়া
বড়ুয়া পদবিটি বাংলাদেশে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের এবং ভারতের আসামে হিন্দুদের পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া আসামে ক্ষেত্রবিশেষে মুসলমানদের পদবি হিসেবেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। মগধ বা বিহার হতে আগত লোকেরা বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বর্তমানে বড়ুয়া নামে পরিচিত।